রাশিয়ার সঙ্গে এক সপ্তাহের তীব্র বাগাড়ম্বরের (যার বেশির ভাগই হয়েছে টুইটারে) পর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র শনিবার সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে দামেস্কের কাছে এবং হোমস প্রদেশের তিনটি স্থানে- এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বাহিনীগুলো একযোগে হামলা চালায়।
যে উত্তেজনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামরিক হামলার ঘোষণা দিয়েছেন, সে তুলনায় হামলার ফলাফল মধ্যমানের চেয়েও কম ছিল।
ঠিক কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় আঘাত হেনেছে- এ সংক্রান্ত পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন বাদ দিলেও ওইসব হামলা কোনো ধরনের সামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটাতে পারেনি এবং সেগুলো সিরিয়ার সামরিক অবকাঠামোর বড় ধরনের কোনো ক্ষতিও করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে টি-৪ ঘাঁটিতে ইসরাইলি বিমান হামলার সঙ্গে তুলনা করলে ১৪ এপ্রিলের হামলাটি তুচ্ছ মনে হতে পারে।
এভাবে দেখলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হামলাগুলো ২০১৭ সালের এপ্রিলের সামরিক পদক্ষেপ থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। ওই সময় ইদলিব প্রদেশের খান শেইখউন শহরে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন শাইরাত বিমান ঘাঁটিতে হামলা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এ বছরের হামলার সঙ্গে পার্থক্যটা ছিল এই যে, যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক হামলার জন্য কেবল সিরিয়া সরকারকেই দায়ী করেনি, একই সঙ্গে দেশটির পৃষ্ঠপোষক রাশিয়াকেও দায়ী করেছে।
এতে করে পরিস্থিতি একটু বেশি মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে সরাসরি সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার জল্পনা-কল্পনা ক্রমবর্ধমান হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সরাসরি দুই বৃহৎ শক্তির মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং পুরো অপারেশনটিকে মনে হয়েছে একটি ‘পারফরম্যান্স’, যা অভিনয় থেকে বেশি কিছু ছিল না।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সবচেয়ে সুবিধা পেয়েছে আসাদ প্রশাসন ও এর মিত্ররা। সিরিয়ায় শক্তির ভারসাম্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলোর কারণে এবং আসাদ প্রশাসনের অনুগত বাহিনীকেও কোনো ধরনের ক্ষতির শিকার হতে হয়নি। বিজয়ীর বেশে দামেস্কে নিজের অফিস প্রাসাদে প্রবেশ করছেন আসাদ- হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এমন একটি ভিডিও পোস্ট করার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন তিনি। হামলার পর সিরীয়রা রাস্তায় উল্লাসে মেতে উঠেছেন এমন দৃশ্য স্থানীয় ও বিদেশি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে।
আসাদ ভাবছিলেন মিডিয়ার জল্পনা-কল্পনা কোন দিকে যায়। গত বছর শাইরাত সামরিক ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা মানুষকে বিস্মিত করেছিল এবং তারপর আন্তর্জাতিক মিডিয়া আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আরও বেশি মারাত্মক সামরিক হামলার সম্ভাবনার কথাও বলেছিল। এ বছর ট্রাম্পের ভাষায় একেবারে নির্ভুলভাবে হামলা চালানোর পর এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, হোয়াইট হাউসের বাগাড়ম্বরের পেছনে কেবল জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আসাদের কাছে এটি স্পষ্ট যে, সিরিয়া যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কৌশল নেই, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার প্রতিরোধের জন্য কার্যকর কোনো কর্মপন্থা নির্ধারণেও দেশটি সক্ষম নয়।
গত বছর যখন শাইরাত বিমান ঘাঁটিতে হামলা করা হয়, তখন রুশ নেতৃত্ব বিষয়টিকে দেখেছে কম ক্ষতিতে ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবেলার কৌশল হিসেবে। এ বছরও মস্কো বুঝতে পেরেছে, সিরিয়ায় হামলা দুমায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে নয়, এমনকি নিশ্চিতভাবেই এর মাধ্যমে সিরিয়া যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবান্বিতও করতে চায় না ওয়াশিংটন। এটি ছিল নিছক একটি শক্তির প্রদর্শন।
সর্বোপরি বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উদ্যোগ নিতে ওয়াশিংটন ছিল যথেষ্ট ধীরগতির এবং এতে করে রাশিয়া বুঝতে পেরেছে যে, এটা অনেকটা দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার বহিঃপ্রকাশ। ফলে বিষয়টি রুশ নেতৃত্বকে কেবল আত্মবিশ্বাসই জুগিয়েছে। এছাড়া ওয়াশিংটনের সঙ্গে সহযোগিতা রক্ষার জন্য বিরূপ মন্তব্য করার ক্ষেত্রে মস্কো ছিল যথেষ্ট মাত্রায় সতর্ক। এর মাধ্যমে সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়ার সম্পত্তির কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগের সপ্তাহে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ হয়েছে বলেই মনে হয়। রাশিয়ার শাসক দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্দ্রেই তুরচাকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন হামলার দিনও দামেস্কে উপস্থিত থাকা থেকে স্পষ্ট হয়, পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে রাশিয়ার আস্থা ছিল। সর্বশেষ বলা যায়, সিরিয়ার বিরুদ্ধে এসব ‘আনুষ্ঠানিক’ হামলা ছিল দুমায় রাসায়নিক হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে উভয়ের জন্য অনুকূল একটি উপায়। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় মস্কো নিজের স্থিতিশীল উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে এবং ‘নীতিগত’ একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে।
কিন্তু হামলার আগে পারস্পরিক তীব্র হুমকির বিষয়ে আমরা কী ধারণা করতে পারি? ২০১৫ সালে রাশিয়া সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মুখোমুখি অবস্থান তীব্রতর বলে জল্পনা-কল্পনা চলে আসছিল। এ বছর ফেডারেল অ্যাসেম্বলিতে দেয়া পুতিনের স্টেট অব দ্য নেশন বক্তব্যে রাশিয়ায় হামলা হলে তৎক্ষণাৎ পাল্টা জবাবের হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। সিরিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলার আগেও প্রতিশোধের হুমকি দেয়া হয়। রাশিয়ার চিফ অব স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ বলেছিলেন, যদি রুশ সেনাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে তবে রাশিয়া ‘ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানবাহী জাহাজের মাধ্যমে উভয় ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
যদি আমরা এটা ধরে নেই যে, মার্কিন প্রশাসন সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি হাইপোথেটিক্যালি বিবেচনা করেছে, তাহলেও ‘প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের’ কথা বলা ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো বিকল্প ছিল না। গত বছরের মতো হামলা ও সংশ্লিষ্ট বিতর্কের পর কোনোকিছু ঘটেনি এবং কোনো ধরনের পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। কারণ রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা ও সরঞ্জামাদির প্রতি কোনো ধরনের হুমকি আসেনি। মস্কোর পক্ষ থেকে ভিন্ন একটি প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশা হতে পারে বেপরোয়া। স্পর্শকাতর বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও রুশ কর্তৃপক্ষ সীমা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করেনি এবং কোনো ধরনের সংঘাতও উসকে দেয়নি।
এটি বৈশ্বিক সশস্ত্র সংঘাত শুরু করাতে পারে এমন চিন্তা বাদ দিলেও উন্নত অস্ত্রের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের বিপরীতে মুখোমুখি অবস্থানের অর্থ হতে পারত রাশিয়ার জন্য সিরিয়ায় একটি পরিপূর্ণ পরাজয়। এ কারণে সিরিয়ায় ইসরাইলের বারবার বিমান হামলার পরও রাশিয়ার কোনো ধরনের জবাব না দেয়াটা বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় নয়। গত ছয় মাস ধরে ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে সিরিয়ার অবকাঠামো এবং সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা করে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে হামা প্রদেশে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় বিমান হামলা করে ইসরাইল। এক মাস পর দামেস্কের কাছে বিমান বিধ্বংসী ব্যাটারি হামলা করা হয়। ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর কাছে অস্ত্র গুদামে হামলা করে তেলআবিব। এভাবে গত ছয় মাসে সিরিয়ায় অনেকগুলো হামলা করেছে ইসরাইল।
অতএব স্পষ্টতই বোঝা যায়, কেন কঠোর ভাষা প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করেছে রাশিয়া। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, সিরিয়ার মাটিতে ক্রেমলিন কোনো ধরনের ঝুঁকি নেবে না। বলা হয়, সিরিয়ার ভূমিতে উত্তেজনা কমার দৃশ্যমান পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাগাড়ম্বরপূর্ণ উত্তেজনাকে খাটো করে দেখা যাবে না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উভয়পক্ষের অনুঘটকদের আচরণে অনিশ্চয়তা লক্ষ করা গেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নিয়ম ও প্রক্রিয়ার প্রতি অসম্মান বাড়ছে। এগুলো ভবিষ্যতে বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে, কারণ এর মাধ্যমে আলোচনা, দরকষাকষি ও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে !
No comments:
Post a Comment