পরিবেশের ও আমাদের জন্য গাছপালা ফুল-ফলগাছ রোপণে করণীয়
গ্রীষ্মের শেষে প্রথম বৃষ্টি হলেই আমরা গাছ রোপণের কথা চিন্তা করি। ভাবি, বাড়ির আশপাশের ফাঁকা জায়গাটা এবার গাছে গাছে ভরিয়ে দেবো। বাদ যাবে না ঘরের বারান্দা কিংবা ছাদও।
অনেকের চিন্তাটা মাথার ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকলেও অনেকে বাস্তবায়ন করতে মাঠেও নেমে পড়ি। প্রিয় গাছের চারা বা কলম খুঁজতে ছুটে যাই সরকারি বা বেসরকারি নার্সারিতে। কাংখিত গাছের চারা বা কলম পেয়েও যাই। তাৎক্ষণিকভাবে রোপণের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়েও ফেলি।
লাগিয়েই ভাবি, যাক কিছু দিনের মধ্যেই জায়গাটা সবুজে সবুজে ভরে যাবে। কিন্তু না, ভাবনার সাথে বাস্তবতাটা ঠিক মেলে না। ক’দিন পরেই দেখা যায় চারা বা কলম সঠিকভাবে বাড়ছে না। শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কী যে হলো চারাগুলোর। চারা বা কলমের এই সমস্যাটা কিন্তু কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখলেই দূর করা যায়। তাহলে চলুন কারণগুলো একে একে জেনে নেয়া যাক।
গ্রীষ্মের শেষে প্রথম বৃষ্টি হলেই গাছের চারা বা কলম রোপণ করা ঠিক নয়। একটু অপেক্ষা করতে হয় পরের দু’তিন বার বৃষ্টির জন্য। কারণ প্রথম বৃষ্টির পর মাটির ভেতরে সৃষ্টি হওয়া গ্যাস বের হওয়ার জন্য বা মাটিতে কিছুটা রস সঞ্চয়ের জন্য সময় দিতে হয়।
তাই পর পর কয়েকবার বৃষ্টি হলে মাটির ভেতর ও বাইরের আবহাওয়া প্রায় সম পর্যায়ে চলে আসে। অর্থাৎ মাটির রস ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এই অবস্খায় গাছের চারা বা কলম রোপণ করলে সেগুলো আর মরে না। প্রতিবìধকতা দূর হওয়ায় চারাগুলো তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকে।
রোপণ করার জন্য যে চারা বা কলম নির্বাচন করা হবে তার বয়স কখনোই এক বা দু’ বছরের বেশি হওয়া চলবে না। আমাদের অনেকেরই ধারণা, বড় আকারের চারা বা কলম রোপণ করলে সেটা খুব তাড়াতাড়ি বড় হবে এবং ফল দিতে শুরু করবে। সত্যি বলতে কি ধারণাটি একদম ভুল। ছোট আকারের নিখুঁত ও তেজি চারা বা কলম সহজেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং দ্রুত বেড়ে ওঠে।
চারা বা কলম বাছাই করার সময় আরো যেসব বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। চারা বা কলমের নতুন পাতা থাকলে সেই চারা বা কলম রোপণের জন্য বাছাই করবেন না। চারা বা কলমে ফুল বা ফল থাকলে সেটাও রোপণের জন্য বাছাই করবেন না। রোপণের জন্য বাছাই করা চারা বা কলমটি সোজা হতে হবে, দুর্বল বা বাঁকা চারা বা কলম বাদ দিতে হবে।
বেশি শাখা-প্রশাখাযুক্ত চারা বা কলম বাছাই করবেন না। বেশি শাখা-প্রশাখা থাকলে সেগুলো ছাঁটাই করে শুধু মূল কাণ্ডটি রেখে রোপণ করতে হবে। রোপণের আগে নিচের দিকের কিছু পাতার অর্ধেক ছাঁটাই করে দিতে হবে। এতে চারা বা কলম থেকে পানি বের হয়ে গাছ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
কলমের গাছের বেলায় জোড় ঠিকমতো আছে কি না, তা পরখ করে নিতে হবে। বিশেষ করে আদিজোড়ে কোনো ফাটা দাগ আছে কি না, তা দেখে নিতে হবে। যদি থাকে তাহলে সেই কলম বাদ দিতে হবে। কলমের জায়গার পলিথিন খোলা হয়েছে কি না রোপণের আগে সেটাও দেখে নিতে হবে।
চারা বা কলমের পাতা কোনো ধরনের পোকামাকড়ে আক্রান্ত থাকলে তা ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক দিয়ে চারা বা কলম ভালোভাবে স্প্রে করার পর রোপণ করতে হবে। রোগাক্রান্ত কোনো চারা বা কলম রোপণের জন্য বাছাই করা ঠিক হবে না। বিশ্বস্ত উৎস বা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক তথ্য নিয়ে উন্নত জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। চারা বা কলমের শিকড় পলিব্যাগ বা মাটির পট ভেদ করে বের হয়েছে কি না সেটা দেখে নিতে হবে।
যদি শিকড় বের হয় তাহলে সেটা ছাঁটাই করে দিতে হবে। পলিব্যাগ বা মাটির পটের মাটি ঠিক আছে কিনা সেটাও দেখে নিতে হবে। যদি চারা বা কলমের গোড়ার মাটি আলগা হয়ে সরে যায় কিংবা পট বা পলিথিন থেকে চারা বা কলম বের করার পর মাটির বল ভেঙে যায় তাহলে সেই চারা বা কলম বাদ দেয়া ভালো। চারা বা কলম কোথায় রোপণ করা হবে সেই জায়গাটি আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে।
রোদ পড়ে এবং ভবিষ্যতে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধার সৃষ্টি না হয় এমন জায়গাই নির্বাচন করতে হবে। চারা বা কলম রোপণের আগেই বড় গাছের জন্য (আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, বাতাবি লেবু, সফেদা) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ১ বর্গ মিটার গর্ত খনন করে কমপক্ষে ৭-১০ দিন খোলা অবস্খায় ফেলে রাখতে হবে। এ সময় গর্ত থেকে তোলা মাটি ঝুরঝুরে করে তার সাথে জৈব সার মিশিয়ে রাখতে হবে। মাঝারি গাছের জন্য (পেয়ারা, লেবু, জলপাই, কামরাঙ্গা, আমড়া) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ৬০ বর্গ সেন্টিমিটার গর্ত খনন করতে হবে।
ছোট গাছের জন্য (কলা, পেঁপে, ডালিম) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ৪৫ বর্গ সেন্টিমিটার গর্ত খনন করতে হবে। রোপণের ঠিক ৩-৪ দিন আগে জৈব সার মিশ্রিত মাটির সাথে রাসায়নিক সার মিশাতে হবে এবং মাটি দিয়ে গর্ত এমনভাবে ভরাট করতে হবে যেন জমির সমতল থেকে ভরাটকৃত মাটির উচ্চতা ১৫-২০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। ভরাট করা মাটি চার দিকে ঢালু করে দিতে হবে যেন পানি সহজেই গড়িয়ে যেতে পারে।
এ সময় প্রয়োজনমতো পানি গর্তের মাটিতে দিতে হবে, যাতে মাটিতে রসের অভাব না হয়। এরপর গর্তের ঠিক মাঝখানে নিড়ানি বা হাত দিয়ে পট বা পলিব্যাগের সমান করে বা একটু বড় করে গর্ত করতে হবে। গর্তের মাঝে চারা বা কলম স্খাপন করতে হবে এমনভাবে যেন চারা বা কলমের গোড়া আগের অবস্খাতেই থাকে।
অর্থাৎ আগে যেটুকু মাটির বলের নিচে ছিল কিংবা যেটুকু মাটির বলের বাইরে ছিল ঠিক সেভাবেই যেন থাকে। এতে চারা বা কলমের গোড়ার বাকল ঠিক থাকে এবং গোড়াপচা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। রোপণ করার পরপরই গাছে এবং গাছের গোড়ার চার দিকে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। রোপণ করা চারা বা কলমের সুরক্ষার জন্য ঘেরার ব্যবস্খা করতে হবে।
মাটির গুণাগুণ জেনে গাছ-পালা লাগাবেন
আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান এবং মাটির গুণাবলী ফল গাছের ফল ধারণ, বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণ- ইত্যাদি বিষয়গুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচিত হলো-
ক. তাপমাত্রা
একেক ধরনের ফল গাছের বৃদ্ধি এবং ফল ধারণের জন্য একেক ধরনের তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। নির্ধারিত পরিধির চেয়ে তাপমাত্রা কম-বেশি হলে ফল চাষে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। একই ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যেও তাপমাত্রার প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হতে পারে।
খ. বৃষ্টিপাত
সব ধরনের ফল গাছেরই বৃষ্টিপাতের চাহিদা সমান নয়। বৃষ্টিপাত কম কিংবা অধিক বৃষ্টি অনেক ফল গাছের ক্ষতি সাধন করে। গাছে ফুল ফোটার সময় অধিক বৃষ্টি হলে পরাগ রেণু ও গর্ভমুণ্ডের আঠালো রস ধুয়ে যায়। ফুলে কীট-পতঙ্গের বিচরণ কমে যায়, এর ফলে নিষেকক্রিয়া ব্যাহত হয়ে ফল উত্পাদন হ্রাস পায়।
বাংলাদেশে ফল উত্পাদনের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার উপাদানগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত এ দুটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ঋতুভেদে কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়।
গ. আলো
ফল গাছের বৃদ্ধি, ফল উত্পাদন এবং ফলের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখতে আলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের ফল গাছের জন্য আলোর চাহিদায় ভিন্নতা রয়েছে।
ঘ. বাতাসের আর্দ্রতা
ফলের আকার, আকৃতি, রং, গুণগতমান ইত্যাদি বাতাসের আর্দ্রতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অনেক ফল শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো জন্মে, আবার কিছু কিছু ফল উত্পাদনের জন্য আর্দ্র আবহাওয়া প্রয়োজন হয়।
ঙ. বাতাসের গতিবেগ
বাতাসের গতিবেগ ফল চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে গাছ এবং মাটির রস দ্রুত নিঃশেষ হয়, এজন্য ঘন ঘন পানি সেচের প্রয়োজন হয়। এর ফলে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ঝড়ো বাতাসে ফল গাছের এবং ফলের অধিক ক্ষতি সাধিত হয়।
চ. মাটির গুণাবলী
সাধারণত, উঁচু জমি ফল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। দেশের সব স্থানের জমির গুণাবলীতেও বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোনো স্থানের মাটি লালচে, কোথাও কালচে, কোনো স্থানের মাটিতে বালির আধিক্য, আবার কোথাওবা কর্দমাক্ত।
কোনো স্থানের মাটিতে লবণের ভাগ বেশি, কোথাও আবার অম্লমান অধিক। কোথাও কম নিষ্কাশিত, কোথাওবা সু-নিষ্কাশিত। পানির স্তর কোথাও কম, কোথাও বেশি। মাটির উর্বরতা এবং ফল উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদানের তারতম্য রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটিতে।
No comments:
Post a Comment